সর্বশেষ
  কুরবানি, ইতিহাস-ঐতিহ্য ও বিধান। মুফতি শরীফ মোহাম্মদ সাঈদ   লন্ডনে সিম্পল রিজনের অফিস পরিদর্শন করলেন মুফতি সাইফুল ইসলাম   লিডসে শায়েখে বাঘা রহঃ-এর জীবন ও কর্ম শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত   বার্মিংহামে শায়েখে বাঘা রহঃ জীবন ও কর্ম শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত   লন্ডনের সভায় আলেমরা বি এ এস বি কমপ্লেক্সকে সহযোগিতার আহবান জানালেন।   বইঃ বশীর আহমদ শায়খে বাঘা রহঃ   বায়রাক্তার টিবি২ দীপ্তিমান করছে তুরস্কের ভাগ্য   জার্মানিতে বছরে শতাধিক মসজিদে হামলা; উদ্বিগ্ন মুসলিমরা   বুজুর্গ উমেদ খাঁ। চট্টগ্রাম পুনরুদ্ধারের মহানায়ক!   ডুরান্ড লাইন! পাক - আফগান দ্বন্দ্বের রেড লাইন!   ত্রিপুরা ও বাংলার ঐতিহাসিক সম্পর্ক | পর্ব ২   ত্রিপুরার সাথে ইসলাম এবং বাংলাদেশের সহস্র বছরের যোগসূত্রের সন্ধানে!   আসামের বর্তমান পরিস্থিতি!   আসামে ইসলামের আগমন ও এন আর সি ক্রাইসিস।   নবাব নুর উদ্দিন মুহাম্মদ বাকের জং। ইতিহাসে ঠাঁই না পাওয়া বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব!   প্রাক-ইসলামিক আরব। ধর্ম, সমাজ ও সংস্কৃতি।   ইউরোপ থেকে ভারতবর্ষের অবিচ্ছিন্ন জলপথ আবিষ্কার।   আফ্রিকার বুকে পর্তুগীজ কলোনি স্থাপনের ইতিহাস।   পূর্ব আফ্রিকায় পর্তুগিজ উপনিবেশ স্থাপন, শোষণ ও ফলাফল   ধর্ষণের আলামত যেভাবে পরীক্ষা করা হয়।   মেটাভার্স   বাংলাদেশের সাথে সামরিক সহযোগিতা বাড়াতে চায় তুরস্ক   লিবারেলিজম।   ইউরোপে ইসলাম বিদ্বেষের উত্থান।    পাকিস্তানে ইসলামী দল, তেহরিক-ই-লাব্বাইক নিষিদ্ধের ঘোষণা।   মুকাদ্দিমাহ রিভিউ। পর্ব- ১১। নেতৃত্বের যোগ্যতা ও ব্যর্থ নেতৃত্ব।   ২০২০ সালের দিল্লি সহিংসতা ছিল একটি সংগঠিত, পরিকল্পিত ‘প্রোগ্রাম’। এবং কেন?   দ্যা রুম হোয়ার ইট হ্যাপেনড। বই রিভিউ। পর্ব-৭   দ্যা রুম হোয়ার ইট হ্যাপেনড। বই রিভিউ। পর্ব-৬   দ্যা রুম হোয়ার ইট হ্যাপেনড। বই রিভিউ। পর্ব-৫   ২০০২ সালের গুজরাট গণহত্যা ও নরেন্দ্র মোদি   দ্যা রুম হোয়ার ইট হ্যাপেনড। বই রিভিউ। পর্ব-৪   দ্যা রুম হোয়ার ইট হ্যাপেনড। বই রিভিউ। পর্ব-৩   দ্যা রুম হোয়ার ইট হ্যাপেনড। বই রিভিউ। পর্ব-২   দ্যা রুম হোয়ার ইট হ্যাপেনড। বই রিভিউ। পর্ব-১   মুকাদ্দিমাহ রিভিউ। পর্ব- ১০   মুকাদ্দিমাহ রিভিউ। পর্ব-৯   মুকাদ্দিমাহ রিভিউ। পর্ব-৮   মুকাদ্দিমাহ রিভিউ। পর্ব-৭   মুকাদ্দিমাহ রিভিউ। পর্ব-৬   মুকাদ্দিমাহ রিভিউ। পর্ব-৫   মুকাদ্দিমাহ রিভিউ। পর্ব-৪   মুকাদ্দিমাহ রিভিউ। পর্ব-৩   মুকাদ্দিমাহ রিভিউ। পর্ব-২   মুকাদ্দিমাহ রিভিউ। পর্ব-১   রিবা নির্মূল হতে পারে সীরাতের পন্থায়!   ১৯৯১ সালে কাশ্মীরের কুনান ও পোশপোরায় গণধর্ষণ। আজও বিচার হয়নি।   নজরদারি: ‘দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত’   ব্যবসার সঙ্গে অন্য সংস্কৃতিকে যুক্ত করার এজেন্ডা!

বুজুর্গ উমেদ খাঁ। চট্টগ্রাম পুনরুদ্ধারের মহানায়ক!

২৮ জানুয়ারি ২০২২ ০১:৫২ অপরাহ্ণ

    শেয়ার করুন

সাইফুদ্দীন আহমদ।

বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ও আধ্যাত্নিক নগরী হিসেবে চট্টগ্রাম আজ সারাবিশ্বে পরিচিত। অথচ একজন ব্যক্তির আগমন না হলে হয়তো এই চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত নাও হতে পারতো। আর সেই ব্যক্তিটি হলেন মোগল সুবাদার শায়েস্তা খাঁর পুত্র চট্টগ্রাম বিজয়ের মহানায়ক বুজুর্গ উমেদ খাঁ!

মধ্যযুগে বঙ্গের সুলতানদের হটিয়ে এক জটিল রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে প্রায় শত বছর চট্টগ্রামে রাজ কায়েম হয়েছিলো মগ দস্যুদের! ফেনী নদী থেকে সমগ্র আরাকান পর্যন্ত বিস্তৃত এই রাজ্যটি আমাদের কাছে সাহিত্যের ভাষায় পরিচিত "মগের মুল্লুক" নামে। ( অর্থাৎ বুঝতেই পারছেন, মগ অধ্যুষিত চট্টগ্রামের তখন কি হাল!) চট্টগ্রাম থেকে এই মগদের হটিয়ে দেন মোগল সেনাপতি বুজুর্গ উমেদ খাঁ!

১৬৬৬ সালের ২৭ শে জানুয়ারি সেই যে চট্টগ্রাম বাংলাদেশের (তৎকালীন সুবা বাঙলার) অন্তর্ভুক্ত হলো, এরপর থেকে আর কখনো বাংলার প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক আওতার বাইরে যায়নি চট্টগ্রাম। মোঘল, ব্রিটিশ, পাকিস্তানি, স্বাধীন বাংলাদেশ যখনই যার শাসন ছিলো না কেনো এই ভূখন্ডে, চট্টগ্রাম সবসময়ই ছিলো বাংলার সাথে, বাংলার প্রবেশদ্বার হিসেবে!

কিন্তু বুজুর্গ উমেদ খাঁ কর্তৃক চট্টগ্রাম বিজয়ের আগে এই ভূমি বাংলা ছাড়াও কখনো মগ রাজা তো কখনো ত্রিপুরা রাজার করায়ত্ত হতো। শায়েস্তা খাঁর পুত্র বুজুর্গ উমেদ খাঁ বহিরাগত শাসকদের এমনভাবে বিতাড়িত করেছেন এই ভূমি থেকে চট্টগ্রামকে আর বাংলা থেকে আলাদা করার দুঃসাহস দেখানোর সুযোগ পায়নি প্রতিবেশী রাজ্যগুলো।

যদিও বুজুর্গ উমেদ খাঁর বিজয়ের আগে দুইবার চট্টগ্রাম বাঙলার অন্তর্ভুক্ত হলেও সে বিজয়গুলো টেকসই ছিলো না!

১ম বার চট্টগ্রাম বিজয়ঃ

১৩৪০ সালে ফখরুদ্দীন মোবারক শাহের আমলে সর্বপ্রথম চট্টগ্রাম মুসলমানদের অধীনে আসে। চট্টগ্রামের কিংবদন্তিতুল্য বদর পীরও এই বিজয়াভিযানে সুলতানের সঙ্গী হন। ১৩৪৬ সালে এই চট্টগ্রাম দিয়েই বাংলাদেশে প্রবেশ করেন বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা। তিনি তার ভ্রমণ কাহিনিতে চট্টগ্রামকে বঙ্গ সালতানাতের অন্তর্ভুক্ত সুন্দর নগর হিসেবে বর্ণনা করেন।

২য় বার চট্টগ্রাম বিজয়ঃ

প্রায় ২০০ বছর মুসলিম শাসনামলের পর ১৫১৩ সালে চট্টগ্রাম আবার বাংলার হাতছাড়া হয়। হোসেন শাহী বংশের সুলতান আলাউদ্দিন হুসেইন শাহের আমলে পাশ্ববর্তী ত্রিপুরা রাজ্য কর্তৃক চট্টগ্রাম দখল করে নেওয়া হয়।

যদিও ত্রিপুরার এই দখলদারিত্ব বেশিদিন বজায় ছিলো না। অচিরেই সুলতান আলাউদ্দিন হুসেইন শাহের পুত্র সুলতান নশরত শাহ কর্তৃক চট্টগ্রাম বিজয় ( ফাতেহ ) করা হয়। চট্টগ্রাম বিজয় করেই সুলতান অঞ্চলটির নাম দেন " ফাতেয়াবাদ "। আজো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন ফাতেয়াবাদ অঞ্চলটি সুলতান নশরত শাহের স্মৃতিকে ধারণ করে আছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বড় দীঘির পাড় নামক জায়গাটি মূলত সুলতান নশরত শাহ কতৃক খননকৃত বড় দীঘিকেই নির্দেশ করে। ঐ বড় দীঘিরপাড় নামক জায়গার পাশে সুলতান নশরত শাহ মসজিদ আজো অস্তিত্ব জারি রেখেছে স্বনামে।

সুলতান নশরত শাহ ত্রিপুরারাজ থেকে চট্টগ্রামকে বিজয় করে আনলেও এই বিজয় টেকসই ছিলো না। যদিও সুলতানের মৃত্যুর পরে আরো পঞ্চাশ বছর চট্টগ্রাম বাংলার সাথে ছিলো। কিন্তু নিত্যনৈমিত্তিক আরাকানরাজের সাথে চট্টগ্রামের দখল নিয়ে বাংলার সুলতানদের সংঘর্ষ লেগেই থাকতো।

১৫৮১ সালে এসে আরাকানরাজ বাংলার আধিপত্য খর্ব করে চট্টগ্রামকে পুরোপুরি আরাকানের অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হয়। বারো আউলিয়ার পূণ্যভূমি, বাংলার রাণী চট্টগ্রাম হয়ে যায় আরাকান মগ এবং পর্তুগীজ জলদস্যুদের  অভয়ারণ্য! মগ - পর্তুগিজ ঐক্যজোট সমগ্র ভাটি বাঙলার জনজীবনকে বিভীষিকাময় করে তোলে। চট্টগ্রামকে ঘাঁটি করে মেঘনা নদীর উপকূলের বিস্তীর্ণ ভূ ভাগে জলদস্যুতা এবং লুটতরাজ চালাতো এই মগ এবং হার্মাদ গোষ্ঠী!  

আরাকান রাজা কর্তৃক মোগল শাহজাদাকে হত্যার মধ্য দিয়ে চট্টগ্রাম বিজয়ের উপলক্ষ তৈরি হয়!

সাল ১৬৫৭। মোগল বাদশাহ শাহাজানের অসুস্থতার সুযোগে গুজব ছড়িয়ে পড়ে দিল্লির বাদশাহ মারা গেছেন। বাদশাহ শাহজাহানের চার পুত্র সিংহাসনের দখল নিয়ে লিপ্ত হয় ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে। যুদ্ধে সকল ভাইকে পরাজিত করে দিল্লীর মসনদে বসেন মোগল সাম্রাজ্য তথা ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ শাসক সুলতান আওরঙ্গজেব আলমগীর!

আওরঙ্গজেব আলমগীরের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাইদের একজন হলো শাহজাদা সুজা। শাহজাদা সুজা ১৬৪০ সাল থেকে ১৬৬০ সাল পর্যন্ত প্রায় ২০ বছর বাংলার সুবাদার (বর্তমান হিসেবে মুখ্যমন্ত্রী পদমর্যাদায়) ছিলেন। ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন এই শাহজাদাও। আওরঙ্গজেবের কাছে বিভিন্ন রণাঙ্গনে হারের পর তিনি তার পরিবার ও সৈন্যদের নিয়ে পালাতে শুরু করেন বাঙলার মধ্য দিয়ে।

শাহজাদা সুজার লক্ষ্য ছিলো নোয়াখালী থেকে জাহাজে করে সমুদ্র পথে মক্কা অথবা ইস্তাম্বুল গমন করবেন। কিন্তু বর্ষাকাল এসে যাওয়ায় তা আর হয়ে উঠেনি। এদিকে বাদশাহ আওরঙ্গজেবের বাহিনী প্রতিনিয়ত খোঁজ করছে শাহজাদা সুজার।

আওরঙ্গজেবের হাতে বন্দী হওয়া থেকে বাঁচতে তাই শাহজাদা সুজা পাশ্ববর্তী আরাকান রাজ্যে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন। আরাকান রাজা শাহজাদা সুজার সেই আবেদনে সাড়া দেন। ১৬৬০ সালের আগস্ট মাসে এককালের পরাক্রমশালী  বাঙলার সুবাদার শাহজাদা সুজার ঠাঁই হলো আরাকান রাজ্যে!

কিন্তু ছয় মাসের মাথায় শাহজাদাকে খুন করে আরাকান রাজা। শাহজাদার পরিবারের মেয়েদের করা হয় লাঞ্ছিত এবং ছেলেদের করা হয় কারারুদ্ধ। মোঘল শাহজাদার এই বিয়োগান্ত সংবাদ অচিরেই পৌঁছে যায় দিল্লি বাদশাহ তথা সুজার ভাই আওরঙ্গজেব আলমগীরের কাছে!

নিজ ভাই হলেও  ক্ষমতার  প্রশ্নে হয়তো কখনোই সুজার প্রতি সহানুভূতি দেখাতেন না বাদশাহ আওরঙ্গজেব। কিন্তু তাই বলে ভিনদেশী কারো হাতে ভাইয়ের খুন! এ যে তৈমুরী (মোগল) বংশের অবমর্যাদা! প্রতাপশালী বাদশাহ আওরঙ্গজেব কী করে এটা বরদাশত করবেন?

আরাকান রাজ কর্তৃক নিজ ভাইয়ের খুনের প্রতিশোধ নিতে তাই দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করেন বাদশাহ আওরঙ্গজেব। নিজ মামা ও দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহচর শায়েস্তা খাঁকে বাংলার সুবাদার করে পাঠান দিল্লি বাদশাহ আওরঙ্গজেব। আর সুবাদার শায়েস্তা খাঁর প্রতি আওরঙ্গজেবের প্রথম নির্দেশই ছিলো, "মগদের শায়েস্তা করো"!

১৬৬৫ সালের শীতকাল। সুবাদার শায়েস্তা খাঁ এক সুসজ্জিত সেনাবাহিনী গঠন করলেন মগদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য। শায়েস্তা খাঁর প্রথম টার্গেটই ছিলো মগদের হাত থেকে চট্টগ্রাম পুনরুদ্ধার করা। চট্টগ্রাম পুনরুদ্ধারের এই মিশনে প্রধান সেনানায়ক হিসেবে যোগ দিলেন সুবাদার শায়েস্তা খাঁর সুযোগ্য পুত্র বুজুর্গ উমেদ খাঁ!

বুজুর্গ উমেদ খাঁ একজন ঠান্ডা মাথার কৌশলী সামরিক ব্যক্তিত্ব এবং প্রশাসক ছিলেন। তিনি বুঝলেন, চট্টগ্রাম বিজয় করতে হলে সমুদ্র এবং স্থল দুই পথেই আক্রমণ পরিচালনা করতে হবে। সমুদ্র পথে আক্রমণ করতে হলে দরকার নৌ ঘাঁটি। আর এই নৌ ঘাঁটি স্থাপনে যুতসই জায়গা হলো সন্দ্বীপ!

কিন্তু সন্দ্বীপে তখন দিলাওয়ার খাঁ নামক সাবেক মোগল সেনাপতির শাসন বজায় ছিলো। তিনি মোগলদের চট্টগ্রাম বিজয়ে সহায়তা করতে রাজি হন নি। আর তাই বুজুর্গ উমেদ খাঁর প্রেরিত নৌ বাহিনী সর্বপ্রথম দিলাওয়ার খাঁকে পরাজিত করে সন্দ্বীপ দখল করে। ( সন্দ্বীপের পঞ্চাশ বছরের স্বাধীন সুলতানের প্রতি সম্মান জানিয়ে দ্বীপটির প্রধান সড়কটির নাম দিলাওয়ার খাঁর নামে নামাঙ্কিত সুদীর্ঘকাল ধরে। )

বুজুর্গ উমেদ খাঁর দ্বিতীয় কৌশল ছিলো পর্তুগিজ এবং মগদের মধ্যে বিবাদ বাড়িয়ে মোগলদের পক্ষে সুবিধা আদায় করা। কূটনৈতিক উপায়ে এবং গোয়েন্দাদের মাধ্যমে এই কাজেও সফল হন তিনি। আর তাই মোঘলদের চট্টগ্রাম আক্রমণের সময় আরাকানদের কোনোরূপ সাহায্য করেনি পর্তুগিজরা।

১৬৬৬ সালের জানুয়ারি মাস! ফেনী নদী পার হয়ে চট্টগ্রাম অভিমুখে ক্রমশই অগ্রসর হচ্ছেন বুজুর্গ উমেদ খাঁ। যাত্রাপথে বুজুর্গ উমেদ খাঁ চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার একটা স্থানে যাত্রাবিরতি করেন এবং একটা মসজিদ নির্মাণ করেন। বুজুর্গ উমেদ খাঁ নির্মিত মসজিদটি আজো আছে এবং সেই গ্রামের নাম এখনো উমেদনগর হিসেবে রয়েছে!

বিশাল সৈন্যবহর সাথে থাকলেও উত্তর চট্টগ্রামের বিস্তীর্ণ জঙ্গল বুজুর্গ উমেদ খাঁর সামনে বাঁধা হিসেবে দাঁড়িয়ে ছিলো! তাই তিনি সৈন্যদলকে নির্দেশনা দিলেন যে, গাছ কেটে কেটে রাস্তা তৈরি করে অগ্রসর হও! মোগল সৈন্যদল দিন রাত এক করে রাস্তা তৈরি করলো চট্টগ্রাম প্রবেশের………

জানুয়ারির শেষদিকে এসে বুজুর্গ উমেদ খাঁর বাহিনী মূল চট্টগ্রাম নগরে এসে পৌঁছায়। এদিকে সমুদ্রপথেও মোগল বাহিনী চট্টগ্রামে নোঙর করতে সক্ষম হয়।

স্থল ও নৌ দুই বাহিনী মিলিত হয়ে ১৬৬৬ সালের ২৪ জানুয়ারি আক্রমণ করে আরাকানদের উপর। আরাকানদের শক্ত ঘাঁটি চাটগিছা কিল্লায় (আন্দরকিল্লা) টানা তিনদিন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয় মোগল এবং মগদের। অবশেষে ২৬ জানুয়ারি পদানত হয় আরাকান বাহিনী।

১৬৬৬ সালের ২৭ জানুয়ারি বিজয়ী বীরের বেশে আন্দরকিল্লা দুর্গে হেলালী নিশান উড়ান সেনাপতি উমেদ খাঁ! মোঘল বাদশাহ আওরঙ্গজেব আলমগীরের নির্দেশে চট্টগ্রামের নতুন নামকরণ করা হয় "ইসলামাবাদ"।

বুজুর্গ উমেদ খাঁর এমন ঐতিহাসিক বিজয়ে স্মরণ করা যায় সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবীর বায়তুল মুকাদ্দাস (জেরুজালেম) বিজয়ের আখ্যান। শত বছর ক্রুসেডারদের দখলে থাকা মুসলিম উম্মাহর প্রথম কিবলাকে দখলমুক্ত করে সুলতান আইয়ুবী যে অসাধারণ কীর্তি স্থাপন করেন, ঠিক তেমনই একশ বছর মগ আর পর্তুগিজদের দখলে থাকা বারো আউলিয়ার পূণ্যভূমি চট্টগ্রামকেও দখলমুক্ত করে অবিস্মরণীয় এক কীর্তি স্থাপন করেন বুজুর্গ উমেদ খাঁ।

বারো আউলিয়ার পূণ্যভূমি চট্টগ্রামে যেনো নতুন করেই ইসলামের আবাদ করেন বুজুর্গ উমেদ খাঁ! তিনি চট্টগ্রামজুড়ে অনেকগুলো মসজিদ, লাইব্রেরি, সরাইখানা স্থাপন করেন। আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ, চন্দনপুরার হামিদিয়া তাজ মসজিদ, চট্টগ্রামের বায়েজিদ থানার অন্তর্গত বটতলীর বায়তুল হামদ হাশেমী মসজিদ  মীরসরাই-এর শায়েস্তা খাঁ মসজিদ আজো বুজুর্গ উমেদ খাঁর কীর্তির জানান দেয়।

শুধু মসজিদ নির্মাণ বা ইসলামের বিকাশ সাধন করে থেমে ছিলেন না বুজুর্গ উমেদ খাঁ। তিনি ছিলেন একজন দক্ষ প্রশাসক। আর তাই বাদশাহ আওরঙ্গজেব তাকে নবাব উপাধি প্রদান করে চট্টগ্রামের শাসনভার প্রদান করেন। বুজুর্গ উমেদ খাঁ নিযুক্ত হলেন চট্টগ্রামের প্রথম মোগল ফৌজদার!

ফৌজদার হয়েই তিনি সমগ্র চট্টগ্রামকে অনন্যভাবে গড়ে তোলেন। তৈরি করেন গতিশীল প্রশাসন, সিস্টেমেটিক রাজস্ব ব্যবস্থা এবং সুদৃঢ় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।

চট্টগ্রামের বিজয় করেই নগরীর মধ্যে বসে থেকে বুজুর্গ উমেদ খাঁ ক্ষান্ত হননি, তিনি চট্টগ্রামের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে দীর্ঘস্থায়ী করারও পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তাই বিজয়ী হয়েই চট্টগ্রামে আরাম আয়েশ ভোগ করার জন্য বসে না থেকে তিনি মোগল বাহিনীসহ চট্টগ্রাম নগরের দক্ষিণে যাত্রা করেন। কারণ দক্ষিণ দিক থেকেই যে মগরা হানা দেয় বারেবারে!

মগদের ক্রমশ চট্টগ্রাম থেকে বিতাড়িত করতে করতে কক্সবাজারের রামু পর্যন্ত পৌঁছান বুজুর্গ উমেদ খাঁ। কিন্তু বর্ষাকাল এসে যাওয়ায় তিনি আর অগ্রসর হননি। আর চট্টগ্রাম থেকে রামু পর্যন্ত রসদ সরবরাহে কষ্ট হওয়ায় বুজুর্গ উমেদ খাঁ রামু হতে কিছুটা পিছিয়ে শঙ্খ (সাঙ্গু) নদীর পাড়ে অবস্থান গ্রহণ করেন।

মোগল বাহিনী সাঙ্গু নদীর তীরে এসে দুর্গ স্থাপন করেন এবং মোগলদের সীমানা সাঙ্গু নদ পর্যন্ত কার্যকর করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এরই লক্ষ্যে সাঙ্গু নদীর তীরে দুইজন সেনানায়ক ( আধু খাঁ এবং লক্ষ্মণ সিং) কে এই স্থানে মোতায়েন করেন বুজুর্গ উমেদ খাঁ। এই দুই সেনানায়ক ছিলেন হাজার সৈন্যের নিয়ন্ত্রক। তাই তাদের নামানুসারে স্থানটির নাম হয় দুইহাজারী > দোহাজারী।

ফিরতি বছর চট্টগ্রাম আবার দখল করতে আরাকান থেকে হামলা চালায় মগরা। সাঙ্গু নদী ও আশেপাশের এরিয়ায় মোগলদের সাথে মগদের ৪ টা যুদ্ধ হয়। বুজুর্গ উমেদ খাঁ কর্তৃক নিয়োজিত মোগল সেনাপতি আধু খাঁর বীরত্বে মোগলরা সবগুলো যুদ্ধে জয়ী হয় এবং সাঙ্গু নদী পর্যন্ত মোগল সীমানা বিস্তৃত হয়। নিশ্চিত হয় চট্টগ্রামের প্রতিরক্ষা।

উল্লেখ্য আধু খাঁর বীরত্বে সমগ্র দক্ষিণ চট্টগ্রাম মোগলদের করায়ত্ত হয়। দক্ষিণ চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার "আধু নগর" ইউনিয়ন আজো আধু খাঁর অস্তিত্বের জানায় দেয় চট্টগ্রামবাসীকে।

আরাকানের মগদের সাথে মোগল বাহিনীর সাঙ্গু নদের পাড়ে সংঘটিত হওয়া যুদ্ধে অনেক মোগল সৈন্য শহীদ হন। তাদের মধ্যে ২২ জনকে রাজকীয়ভাবে দাফন করা হয় চন্দনাইশ উপজেলার হাশিমপুর ইউনিয়নের বাগিচাহাট নামক এলাকায়।(যার আসল নাম হলো বাগ - ই - শাহ)  আজো সেই কবরস্থান তার অস্তিত্ব বজায় রেখে জানান দিচ্ছে, চট্টগ্রামের মাটি তাদের রক্তেই কেনা!

চট্টগ্রাম নগর গঠনে মোগলদের ভূমিকা!

মোগলরা শুধুমাত্র চট্টগ্রাম দখল করে এর সুবিধা নেওয়ার জন্য আসেনি। বরং মোগলরা চট্টগ্রামকে একটা পরিপূর্ণ নগর হিসেবে গড়ে তোলে। চট্টগ্রাম জুড়ে স্থাপিত অনেক মোগল স্থাপনা কালের গর্ভে হারিয়ে গেলেও বেশকিছু এখনো টিকে আছে।

→ আসকার দিঘী! চট্টগ্রামের দ্বিতীয় মোগল ফৌজদার আসকার খাঁ কর্তৃক নির্মীত এই সুবিশাল দীঘি নগরীর কাজির দেউড়ি ও জামালখান মোড়ের মাঝে আজো টিকে রয়েছে।

→ ঘাট ফরহাদ বেগ! মোগল নবাব ফরহাদ খাঁ কর্তৃক নির্মিত ঘাট।

→ আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ, ওয়ালী বেগ খাঁ মসজিদ, হামজা খাঁ মসজিদ, কদম মোবারক মসজিদ, হামিদিয়া তাজ মসজিদ, শেখ বাহার উল্লাহ মসজিদসহ নগরজুড়ে থাকা বেশকিছু প্রাচীন মসজিদ মোগল আমলে মোগল স্থাপত্য রীতিতে তৈরি।

বুজুর্গ উমেদ খাঁর চট্টগ্রামের দুর্গ বিজয় এবং তার অধীনস্থ সেনাপতি আধু খাঁর সাঙ্গু নদের পাড় পর্যন্ত বিজয় বাংলার ইতিহাসের অন্যতম যুগান্তকারী ঘটনা। এই বিজয়ের প্রভাব ছিলো সুদূরপ্রসারী।

সাঙ্গু নদ পর্যন্ত একচ্ছত্র মোগল আধিপত্য পরে ধীরে ধীরে নাফ নদী পর্যন্ত প্রসারিত হয় অর্থাৎ কক্সবাজার ও বাঙলার অন্তর্ভুক্ত হয়। এছাড়াও চট্টগ্রাম বিজয় এই অঞ্চলে বাঙলার আধিপত্যকে সুদৃঢ় করে তোলে। পাশ্ববর্তী আরাকান এবং ত্রিপুরাদের তুলনায় বাঙালি জাতি যে শক্তি সামর্থ্যে  এগিয়ে, চট্টগ্রাম বিজয় তারই নিদর্শন।

চট্টগ্রাম বাংলাদেশের হলো! আজো বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ, সামনেও থাকার কথা। কিন্তু একজন বুজুর্গ উমেদ খাঁ না থাকলে এই চট্টগ্রাম হয়তো আজ আরাকানের মতো (বাঙালি আর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল হয়েও) হয়তো বাংলাদেশের অংশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতো না।

কিন্তু যেই বুজুর্গ উমেদ খাঁর জন্য চট্টগ্রাম স্থায়ীভাবে বাংলার অংশ হলো, সেই উমেদ খাঁকে কী আমরা মনে রেখেছি? চট্টগ্রাম জুড়ে অসংখ্য স্থাপনা বিভিন্ন রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক ব্যক্তিবর্গের নামে। বিভিন্ন ব্যক্তির জন্ম, মৃত্যু দিবসও পালন হয় আড়ম্বরপূর্ণভাবে। অথচ বুজুর্গ উমেদ খাঁর নামে কোনো কিছুই নেই সমগ্র বাংলাদেশে এমনকি তার বিজয়কৃত চট্টগ্রামেও। চট্টগ্রাম বিজয়ের দিবসও পালিত হয় না এই নগরের কোথাও।

জাতি হিসেবে চট্টগ্রাম বিজয় আমাদের জন্য যতটা গৌরবের, চট্টগ্রাম বিজয়ের মহানায়ককে স্মরণে না রাখাটা কি ততটাই লজ্জার নয়?

The Global Affairs - সর্বশেষ সংবাদ ও শিরোনাম

কুরবানি, ইতিহাস-ঐতিহ্য ও বিধান। মুফতি শরীফ মোহাম্মদ সাঈদ

The Global Affairs - সর্বশেষ সংবাদ ও শিরোনাম

লন্ডনে সিম্পল রিজনের অফিস পরিদর্শন করলেন মুফতি সাইফুল ইসলাম

The Global Affairs - সর্বশেষ সংবাদ ও শিরোনাম

লিডসে শায়েখে বাঘা রহঃ-এর জীবন ও কর্ম শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত

The Global Affairs - সর্বশেষ সংবাদ ও শিরোনাম

লন্ডনের সভায় আলেমরা বি এ এস বি কমপ্লেক্সকে সহযোগিতার আহবান জানালেন।

The Global Affairs - সর্বশেষ সংবাদ ও শিরোনাম

বইঃ বশীর আহমদ শায়খে বাঘা রহঃ

The Global Affairs - সর্বশেষ সংবাদ ও শিরোনাম

বার্মিংহামে শায়েখে বাঘা রহঃ জীবন ও কর্ম শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত

The Global Affairs - সর্বশেষ সংবাদ ও শিরোনাম

বায়রাক্তার টিবি২ দীপ্তিমান করছে তুরস্কের ভাগ্য

The Global Affairs - সর্বশেষ সংবাদ ও শিরোনাম

জার্মানিতে বছরে শতাধিক মসজিদে হামলা; উদ্বিগ্ন মুসলিমরা

The Global Affairs - সর্বশেষ সংবাদ ও শিরোনাম

বুজুর্গ উমেদ খাঁ। চট্টগ্রাম পুনরুদ্ধারের মহানায়ক!

The Global Affairs - সর্বশেষ সংবাদ ও শিরোনাম

ডুরান্ড লাইন! পাক - আফগান দ্বন্দ্বের রেড লাইন!

The Global Affairs - সর্বশেষ সংবাদ ও শিরোনাম

ত্রিপুরা ও বাংলার ঐতিহাসিক সম্পর্ক | পর্ব ২

The Global Affairs - সর্বশেষ সংবাদ ও শিরোনাম

ত্রিপুরার সাথে ইসলাম এবং বাংলাদেশের সহস্র বছরের যোগসূত্রের সন্ধানে!

The Global Affairs - সর্বশেষ সংবাদ ও শিরোনাম

পূর্ব আফ্রিকায় পর্তুগিজ উপনিবেশ স্থাপন, শোষণ ও ফলাফল

The Global Affairs - সর্বশেষ সংবাদ ও শিরোনাম

আফ্রিকার বুকে পর্তুগীজ কলোনি স্থাপনের ইতিহাস।

The Global Affairs - সর্বশেষ সংবাদ ও শিরোনাম

ইউরোপ থেকে ভারতবর্ষের অবিচ্ছিন্ন জলপথ আবিষ্কার।

the global affairs google play logo the global affairs apple logo

সম্পাদক ও প্রকাশকঃ হোসাইন আহমদ

info@theglobalaffairs.info